ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে কাল শুক্রবার সরকারি সফরে নয়াদিল্লি যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বিপক্ষীয় সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। এ ছাড়া ভূ-রাজনীতি, তিস্তা চুক্তি, জ্বালানি বাণিজ্যসহ বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের তালিকায় রয়েছে।
সফরের দ্বিতীয় দিন শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে।গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিস্তারিত জানানো হয়েছে। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য, সংযুক্তি, তিস্তা চুক্তি, জ্বালানি, সীমান্ত হত্যা, প্রতিরক্ষা, নতুন প্রযুক্তিসহ দ্বিপক্ষীয় অনেক বিষয়ে দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা হতে পারে। সফরে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা সইয়ের (এমওইউ) কথা রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ঋণচুক্তি বাস্তবায়নে গতি আনতে নতুন রূপরেখা চুক্তি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে আলোচনা প্রাধান্য পাবে। যদিও সফরের ঠিক আগমুহূর্ত পর্যন্ত চুক্তি ও সমঝোতার ক্ষেত্রে যেকোনো পরিবর্তন হয়ে থাকে।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন সফরের আগে শেখ হাসিনার ভারত সফর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের শীর্ষ নেতার মধ্যে চীনের অবস্থান নিয়ে আলোচনা গুরুত্ব পাবে। তারা মনে করেন, ভারত ও চীনের মধ্যে যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক চলছে, সেই প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কীভাবে দেখতে চায়, সে বিষয়টি ভারত স্পষ্ট করবে। এই সফরে দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা ও আলোচনা, অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দুই দেশের অবস্থানসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলেও মনে করেন সাবেক কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
১৫ বছর ধরেই ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক উচ্চতর থেকে উচ্চতর পর্যায়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে এবারের সফরে রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত হবে এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবারের সফরকে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকেই বিবেচনা করা দরকার। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুধু দ্বিপক্ষীয় উপাদানের ওপর নির্ভর করে না। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সম্প্রসারণ ও গভীরতা বাড়ছে। আর বেইজিং-দিল্লি অস্বস্তিকর সম্পর্কে এর মধ্যে একটা বড় রকমের প্রভাব ফেলে। চীন সফরের আগে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এটিও গুরুত্ব পাবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের নির্বাচনের পর দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করাই হবে দুই প্রধানমন্ত্রীর মূল আলোচনা। অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা থাকবে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, টানা চতুর্থবারের মতো সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শেখ হাসিনা ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসির কথা বলে এসেছেন। দিল্লি সফরে তার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে।
তিনি বলেন, সব সময়ই ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আলোচনায় নানাভাবে চীনের বিষয়টি এসেছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অগ্রসরমান। এখন বাংলাদেশকে প্রায় ভারসাম্যের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগোতে হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন করে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল যুক্ত হয়েছে। তাই হাসিনা-মোদি বৈঠকে এবার ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু প্রাধান্য পাবে। আর ফরমালি অমীমাংসিত ইস্যুগুলো প্রাধান্য পাবে।
ভারতীয় গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যমের এক খবরে বলা হয়েছে, মোংলা বন্দরে একটি টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায় ভারত। ইরানের চাবাহার ও মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরের মতো মোংলা বন্দরেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বলা হয়, মোংলা বন্দরকে ঘিরে চীনের একাধিক প্রকল্পের কারণে ভারতের আগ্রহ এখন এই বন্দরে।
এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হয়েছিল। প্রায় দুই বছর পর আগামী শনিবার আবার দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসছেন।
এর মধ্যে ৮ জুন দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফরটি জুনে হচ্ছে না বলে ধারণা করা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, চীন সফরের পর শেখ হাসিনা ভারত যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিনি ২১ জুনই দিল্লি যাচ্ছেন।
এর আগে ২০২১ সালে শেষবার ঢাকায় এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি।
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে. সফরে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিদলে কারা থাকবেন এরই মধ্যে কূটনৈতিক রীতি অনুযায়ী সেই তালিকা দিল্লির কাছে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ রয়েছেন এই তালিকায়। এর আগে সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরদের সফরে যুক্ত করা হয়েছে কম। এবারের সফরে থাকছেন বাংলাদেশের ইকোনমিক রিলেশনস (অর্থনৈতিক সম্পর্ক) বিভাগের সচিব মহ. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকি, বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মহ. হাবিবুর রহমান, রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মহম্মদ হুমায়ুন কবীর, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের (সেনাবাহিনী) প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, বাহিনীর অপারেশনস ও প্ল্যান ডিরেক্টরেটের কর্নেল মহম্মদ তরিকুল ইসলাম। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক এটিএম রকিবুল হক ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও যাচ্ছেন এই সফরে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অ্যাম্বাসেডর-অ্যাট-লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বাংলাদেশ সরকারের ডাক, টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম সফরে থাকছেন।
প্রতিনিধিদলের তালিকা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এই দ্বিপক্ষীয় সফরে অর্থনীতি, বাণিজ্য, রেল, বিদ্যুৎ ও প্রতিরক্ষা খাতে দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতা সম্পাদিত হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো তথ্যমতে, কাল শুক্রবার বেলা ২টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে পালাম বিমানবন্দরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সফরসঙ্গী দল। দিল্লিতে পৌঁছার পর এ দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আবাসস্থলে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর।
সফরের দ্বিতীয় দিন শনিবার সকালে শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লির ফোরকোর্টে রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী সালাম গ্রহণ ও গার্ড অব অনার পরিদর্শন করবেন। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হবে। ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ছবিও তোলা হবে।
এরপর শেখ হাসিনা রাজঘাটে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও পরিদর্শন বইয়ে সই করবেন।
একই দিন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক উপলক্ষে হায়দরাবাদ হাউসে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠক হবে। প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনা এবং দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এমওইউ ও চুক্তি বিনিময় এবং দুই নেতার প্রেস বিবৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এখানে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজ আয়োজনের কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করবেন; প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ছবি তোলার আয়োজনও থাকছে এই পর্বে।
শনিবার বিকেলে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখাড়ের সঙ্গে তার সচিবালয়ে সাক্ষাৎ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপরাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবেন। এ সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হবে।
দুদিনের এ সফর শেষে এদিন সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে করে ঢাকার উদ্দেশে নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দর ত্যাগ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকা অফিস
সিটিহার্ট বিল্ডিং, সুইফটঃ ১৩/১, ৬৭ নয়াপল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল : 0১৬৭৩৭২৮৮৬৫
ই-মেইল : sangbadprothom@gmail.com
Copyright © 2025 দৈনিক প্রথম সংবাদ. All rights reserved.